ঋতু পরিবর্তনের ফলে শীতকালে শিশুরা খুব অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ সময় শিশুর যত্নে সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। শীতকালে শিশুর চাই বাড়তি যত্ন।
শীতে বাড়ে সর্দি-জ্বর, ব্রঙ্কিওলাইটিস(শ্বাসকষ্ট), নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়া। শীতে নবজাতক শিশুর (১ থেকে ২৮ দিন বয়সী শিশু) জন্য আরও বেশি যত্নবান হতে হয়।
সাধারণ সর্দি-জ্বর বা ভাইরাল ফ্লু
শীতে শুধু ঠান্ডা লাগার কারণেই যে শিশু অসুস্থ হবে তা নয়। যেহেতু শীতকালীন অসুখের মূল কারণ বায়ুবাহিত রোগজীবাণু যা সহজেই ছড়িয়ে পড়ে ও শিশুদের আক্রমণ করে। একই সঙ্গে থাকে প্রচুর ধুলাবালি, যা শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে নাক দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে।
ফলে গলায় কিংবা নাকে প্রদাহ, সর্দি, কাশি’সহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। মাত্রাতিরিক্ত দূষিত ধোঁয়া ও ধুলা শিশুদের নিউমোনিয়া কিংবা ব্রঙ্কাইটিসের মতো সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে।
শীতের শুরুতে সাধারণত সর্দি জ্বর বা ভাইরাল ফ্লু হতে পারে। এটি ভাইরাসজনিত একটি ছোঁয়াচে রোগ। যা ৫-৭ দিনে ভালো হয়ে যায়। এ সময় ছোট ছোট সমস্যায় পড়ে শিশুরা।
নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া, নাক দিয়ে পানি পড়া, শরীরের চুলকানি, খাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, বুকে আওয়াজ হওয়া, হালকা বা শুষ্ক কাশি ও সঙ্গে থাকে জ্বর।
এক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের সাধারণত প্রয়োজন হয় না, কফ সিরাপ ও অ্যান্টি সিস্টামিনজাতীয় ওষুধ সেবনে শিশু সুস্থ হয়ে যায়।
এ সময় শিশুকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত গোসল করানো, পুষ্টিকর খাবার বিশেষ করে শীতকালীন সবুজ শাকসবজি খাওয়াতে হবে, লেবু পানিও খাওয়াতে পারেন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা উন্নত করতে।
হাঁচি-কাশি বা সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে শিশুকে দূরে রাখতে হবে। শিশুর সুরক্ষায় ঘরে সবাই এ সময় মাস্ক পরুন। কোন জিনিস স্পর্শ করলে হ্যান্ড সেনিটাইজার ব্যবহার করুন ও শিশুকেও শেখান।
নিউমোনিয়া
ফুসফুসের অ্যালভিওলিতে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা প্রদাহ হলে নিউমোনিয়ার লক্ষণ চলে আসে। নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে দ্রুতগতির শ্বাস-প্রশ্বাস বা ফার্স্ট ব্রিদিং দেখা যায়।
২ মাসের কমবয়সী শিশুদের শ্বাস নেওয়ার হার প্রতি মিনিটে ৬০ বারের বেশি, ২ মাস থেকে ১২ মাস বয়সী শিশুদের প্রতি মিনিটে ৫০ বারের বেশি ও বারো মাস থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুর প্রতি মিনিটে ৪০ বারের বেশি শ্বাস-প্রশ্বাস নিলে তাকে শ্বাসকষ্ট বলা হয়।
কাশি, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, দ্রুত নিঃশ্বাস, পাঁজরের নিচের অংশ ভেতরের দিকে দেবে যাওয়া, শিশু খেতে না পারলে, বুকের ভেতর শব্দ হলে, নিস্তেজ হয়ে গেলে বুঝতে হবে শিশুটি মারাত্মক নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত।
ব্রঙ্কিওলাইটিস
নিম্ন শ্বাসতন্ত্রের একটি সংক্রমণ এটি। ফুসফুসের ক্ষুদ্রনালি ব্রঙ্কিউলে ভাইরাসের কারণে প্রদাহ হলে সাধারণত ব্রঙ্কিওলাইটিস হয়। দুই বছরের কম বয়সের শিশুদের মধ্যে নাক দিয়ে পানি পড়া সঙ্গে শ্বাসকষ্ট ও কাশি থাকে।
এই শ্বাসকষ্টকে নিউমোনিয়া ভেবে অনেক চিকিৎসকই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করেন শিশুর। ফলে ছোটবেলা থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায় শিশুর। তাই ব্রঙ্কিওলাইটিস শনাক্তকরণ খুব জরুরি।
সাধারণত ৩-৫ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যায় ও ৭-১০ দিনের মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও শ্বাসকষ্টের রেজুলেশন দেখা যায়। অনেক সময় কাশি থাকে প্রায় ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত। অবস্থা গুরুতর হলে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয় শিশুর।
নিউমোনিয়া থেকে ব্রঙ্কিওলাইটিস খুব সহজেই পার্থক্য করা যায়। নিউমোনিয়া সাধারণত যে কোনো বয়সে হতে পারে। সঙ্গে জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট থাকবে। এক্স-রে করলে কালো ফুসফুসে সাদা সাদা দাগ দেখা যাবে। আর রক্ত পরীক্ষায় সাধারণত শ্বেত কণিকার পরিমাণ অনেক বেশি থাকবে।
হাঁপানি
শিশুর হাঁপানি সাধারণত ১২-১৮ মাস বয়সীদের মধ্যে দেখা যায়। ফলে অভিভাবকরা এই সমস্যা শনাক্ত করতে পারেন না সহজে। অ্যাজমা শ্বাসকষ্টজনিত রোগ। এতে আক্রান্ত হলে শিশুর শ্বাসনালিতে প্রদাহ ও সংকীর্ণতার সৃষ্টি হয়। ফলে শ্বাস নিতে অসুবিধা হয় শিশুর।
আবহাওয়া পরিবর্তনে বা শীতের শুরুতে এর প্রকোপ বেড়ে যায়। অ্যালার্জির সমস্যার কারণেও অনেক সময় অ্যাজমা দেখা দেয়। ডাক্তারের পরামর্শ মত চললে একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব খুব সহজেই।
এর লক্ষণগুলো হলো- দম বন্ধভাব, শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট হওয়া, শোঁ শোঁ শব্দ, ঘুম থেকে উঠে বসা, এসব লক্ষণই প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করতে সাহায্য করে অ্যাজমা। এ সমস্যা থেকে শিশুকে বাঁচাতে ঠান্ডা লাগানো যাবে না।
হাঁপানি আক্রান্ত শিশুদের সামনে ধূমপান নিষিদ্ধ। কোনো খাবারে অ্যালার্জি থাকলে সেগুলো শিশুকে খাওয়াবেন না। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে শিশুকে। এছাড়া ধুলাবালি থেকে শিশুকে সুরক্ষিত রাখুন।
ডায়রিয়া
শীতের শুরুতে ডায়রিয়াও দেখা যায় শিশুদের মধ্যে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারাদিনে তিনবার বা তার বেশিবার পানির মতো পায়খানা হলে ডায়রিয়া বলা যেতে পারে। এটি ভাইরাস (রোটা, এডিনো ভাইরাস), ব্যাকটেরিয়া (সালমনেলা, সিগেলা, ইকোলাই) ও পরজীবী (জিয়ারডিয়া) দ্বারা সংঘটিত হয়।
ভালোভাবে হাত না ধুলে এর মাধ্যমে ডায়রিয়ার জীবাণু সবখানে ছড়াতে পারে। যা পরবর্তী সময়ে কঠিন ব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শীতে গরম পানিতে শিশুকে হাত ধোওয়ানোর অভ্যাস করুন।
শীতে শিশুদের বেশি বেশি হালকা গরম পানি পান করতে দিন। এতে শিশুর পানিশুন্যতা পূরণ হবে আর গরম পানি তাকে ঠান্ডা লাগা থেকে দূরে রাখবে।
চর্মরোগ
শীতে সবার ত্বকই শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যায়। এ কারণে চর্মরোগের ঝুঁকি বাড়ে। শীতে ত্বকের পর্যাপ্ত ময়েশ্চারাইজার দরকার হয়। এ সময় ত্বকের যত্ন না নিলে শিশুরা ছোঁয়াচে চর্মরোগে আক্রান্ত হতে পারে।
শীতে শিশুর ত্বকের যত্ন নিতে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মিত লোশন লাগাতে হবে যেন ত্বক শুষ্ক হয়ে না যায়। শীতকালের ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে শিশুকে সুরক্ষা দিতে খোলামেলা পরিবেশে খুব বেশি খেলাধুলা করতে না দেওয়াই ভালো। বিশেষ করে শৈতপ্রবাহের সময়।
খুব বেশি ঠান্ডা আবহাওয়া শিশুদের অনেক ক্ষতি করে আর কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। লক্ষ্য রাখতে হবে শিশু যেন মেঝেতে খালি পায়ে না হাঁটে। ঘরের মেঝেতেও মাদুর বা মোটা কাপড় বিছিয়ে দিতে পারেন। তাহলে মেঝেতে বসে খেলা করলেও ঠান্ডা লাগবে না।
শিশুকে শীতকালে বেশি বেশি ফল-মূল, শাকসবজি ও সুষম খাদ্য খাওয়ানো উচিত। এতে বাড়বে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। মোটকথা, শিশুর ভিটামিন প্রাকৃতিকভাবেই পূরণ করতে হবে।
এছাড়া দৈনিক এক চামচ মধু খাওয়ালে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে ও সর্দি-কাশি কিংবা ঠান্ডা লাগা কমবে। এ সময় শিশুকে আইসক্রিম, ঠান্ডা পানি বা ফ্রিজের কোনো খাবার খাওয়াবেন না। আর ফ্যান ছেড়ে ঘুমাবেন না, এতে শিশুর টনসিল বা গলায় ব্যথা হতে পারে।
শিশুকে সুস্থ রাখতে ঠান্ডা আবহাওয়ায় দুপুর ১২টার আগেই গোসলের পর্ব সেরে ফেলুন। গোসলের পর শিশুর মাথা ও শরীর ভালো করে মুছে তারপর জামা কাপড় পরাতে হবে। ত্বক ভালো রাখতে অবশ্যই বেবি লোশন বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করবেন।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য শিশুর শরীর হালকা গরম পানি দিয়ে ধোয়ালেও মাথা ধোয়ানোর সময় অবশ্যই স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি ব্যবহার করতে হবে। বেবি শ্যাম্পু ব্যবহার করতে হবে সপ্তাহে এক বা দুদিন।
শীতে শিশুকে আরামদায়ক ও কিছু বাড়তি গরম কাপড় পরাবেন। তার মাথা, ঘাড়, হাত ও পা ভালোভাবে গরম কাপড়ে ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করুন। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে শিশুদের এক লেয়ার বেশি কাপড় নিশ্চিত করতে হবে। তবে অতিরিক্ত গরম কাপড় পরাবেন না। এতে শিশু ঘেমে আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল। প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল।