ভারত থেকে প্রবেশ করে পদ্মা নদীর সঙ্গে সংযোগ হওয়া মহানন্দা নদীতে জেলা শহরের রেহাইচর এলাকায় বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুর ভাটিতে নির্মাণ হচ্ছে এ প্রকল্পটি।
এ কাজ শেষ হলে নদীর দুই ধারের ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও ৫৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকার কৃষি উৎপাদন ও দুই কোটি ৩৭ লাখ টাকার মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এর পাশাপাশি নদীপাড়ের বাসিন্দাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে প্রকল্পটি।
ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাব, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার, বৃষ্টি কমে যাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা পানিশূন্য হয়ে পড়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এখনকার পানিশূন্য মহানন্দা নদীতে সারাবছর প্রায় ১৫-২০ ফিট পানি থাকবে। এ পানিতে বছরজুড়ে দেশি মাছ আহরণ ও কৃষি জমিতে চাষাবাদের পরিমাণ বাড়বে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্টদের দাবি, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে সহজে মেলে না খাবার পানি। এমনকি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক টিউবওয়েল।
রাবার ড্যাম প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বছরজুড়ে নদীর পানি থাকার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক থাকবে। ফলে সহজেই মিলবে সুপেয় পানি।
সদর উপজেলার বারোঘরিয়ার ষাটোর্ধ্ব কৃষক আহমেদ আলী জানান, রাবার ড্যামের কাজ শেষ হলে নদীর দুই ধারের অনেক পতিত জমি চাষাবাদ হবে। এমনকি বরেন্দ্র অঞ্চলের শতশত বিঘা পতিত থাকা জমিতেই সেচ সুবিধা পাওয়া যাবে।
একদিকে যেমন এই এলাকা মরুকরণের হাত থেকে রক্ষা পাবে, তেমনি অন্যদিকে কৃষিতে চাষাবাদ বাড়বে। তাই আমাদের দাবি, দ্রুত এর কাজ শেষ করা হোক।
স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী শামসুল আলম বলেন, নদীতে এখন তেমন মাছ পাওয়া যায় না। পানি না থাকলে মাছ থাকবে কোথায়। বর্ষা ছাড়া বাকি ৮-৯ মাস নদীতে চর জেগে ওঠে। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলেদের খেলার মাঠে পরিনত হয় মহানন্দা নদী।
আমরা আশা করছি, রাবার ড্যাম নির্মাণ হলে বছরজুড়ে পানি থাকবে। এতে মাছের উৎপাদনও স্বাভাবিকভাবেই বৃদ্ধি পাবে।
জেলা শহরের মসজিদপাড়া মহল্লার বাসিন্দা আব্দুল কাদের জানান, খরার সময়ে টিউবওয়েলে পানি আসে না। এমনকি আমাদের এলাকার অনেক টিউবওয়েল বন্ধ হয়ে গেছে। খুব পানির সংকটে থাকি শুষ্ক সময়ে। এ রাবার ড্যাম হওয়ার ফলে এই সংকট কেটে যাবে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোজাহার আলী প্রাং বলেন, রাবার ড্যামের ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে চাষাবাদের উঁচু জমিতে সেচ সুবিধার পাশাপাশি কমবে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ও অনাবাদি জমির পরিমাণ।
নতুন করে আরও অনাবাদি জমি বৃদ্ধির পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধি পাবে।
ইতোমধ্যে ৩৯৩ মিটার দৈর্ঘ্যের রাবার ড্যাম প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৮৭ শতাংশ।
আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে বাকি কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান।
তিনি জানান, মহানন্দা নদীর নাব্য ঠিক রাখতে ড্রেজিং ও ভাঙনরোধে রাবার ড্যাম নির্মাণ প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণ শুরু হয় ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়।
এজন্য ১৮৭ কোটি ৩১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করে প্রকল্প প্রক্রিয়াকরণ করে পরিকল্পনা কমিশন। পরে এর ব্যয় বাড়িয়ে ২৫১ কোটি টাকা করা হয়।
তিনি আরও জানান, ৩৫৩ মিটার দৈর্ঘ্যের এ রাবার ড্যামের উজান ও ভাটিতে ৩৬ কিলোমিটার এলাকায় ড্রেজিং করে নদী খনন করা হয়েছে। এর মধ্যে উজানে ১০ কিলোমিটার এবং ভাটি এলাকায় ২৬ কিলোমিটার নদী ড্রেজিং করা হয়।
৩৬ কিলোমিটার নদী খনন ছাড়াও প্রায় সাত হেক্টর জমি অধিগ্রহণ, রাবারড্যাম নির্মাণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম থাকবে এ প্রকল্পের অধীনে। এটি দক্ষিণ এশিয়ার ১০ম বৃহত্তম রাবার ড্যাম বলেও জানান তিনি।
প্রকল্পটিকে লাভজনক হিসেবে উল্লেখ করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১০ কোটি ৭৫ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪৯ কোটি ১৬ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাড়ে ৬০ কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৬ কোটি ৮৯ লাভ টাকা অর্থায়নের জন্য চাহিদা চাওয়া হয়েছে।
২০১১ সালের ১১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁপাইনবাবগঞ্জ সফরে এসে স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মহানন্দা নদীতে রাবার ড্যাম নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রায় এক দশক পর শুরু হয় রাবার ড্যামের নির্মাণ কাজ।