করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়ার পরও দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন করোনায় আক্রান্তরা। করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাকালে এসব তথ্য জানতে পারেন চিকিৎসকরা। এ বিষয়ে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইদুল ইসলাম বলেন, করোনা থেকে সেরে ওঠার পরবর্তী জটিলতা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের জটিলতা ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের বেশি পাওয়া যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা ব্যক্তিদের করোনা সংক্রমিত হওয়ার আগে এ সমস্যা ছিল না। করোনা সংক্রমণে ফুসফুস মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ধরনের রোগীদের দীর্ঘ মেয়াদে ওষুধ সেবন ও রোগটা বহুদিন পর্যন্ত শরীরে বহন করতে হচ্ছে। শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে মানসিক জটিলতা।
চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তিরা মূলত কয়েকটি সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। তন্মধ্যে হচ্ছে,
ফুসফুস সমস্যা
হৃদপিণ্ড সমস্যা
কিডনি সমস্যা
লিভার সমস্যা
রক্ত জমাট বাঁধা ও রক্তনালির বিভিন্ন সমস্যা
ডায়াবেটিস
উচ্চ রক্তচাপের নিয়ন্ত্রণহীনতা
মানসিক সমস্যা
হাইপারটেনশন
ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন
চিকিৎসকরা আরও দেখেছেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে ফুসফুসের ১০-১২ শতাংশ সংক্রমণ হয়েছিলো। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পরে আবার যখন অসুস্থ হলো তখন তাদের ৭০% পর্যন্ত ফুসফুস ড্যামেজ।
করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হওয়ার পরও অনেক রোগী বাড়ি ফেরার পর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বা পিটিএসডি রোগে আক্রান্ত হন। হসপিটাল বা আইসিইউতে থাকার ভীতিকর স্মৃতি থেকে অনেকে বের হতে পারেন না।
আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর, সর্দি, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি লোপ পাওয়া, অবসাদ ও দুর্বলতার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে করোনা সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার তিন মাস পর ৭৮ শতাংশের শরীরে নানা ধরনের জটিলতা দেখা যাচ্ছে। ছয় মাস পর ৭০ শতাংশ, ৯ মাস পর ৬৮ শতাংশ এবং এক বছর পরও ৪৫ শতাংশ উত্তরদাতা বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় ভোগার কথা বলেছেন। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, করোনা সংক্রমণ থেকে সুস্থ হলেও সংক্রমিত ব্যক্তির নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। তন্মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ঘুম না হওয়া, বুকে ব্যথা, হৃদযন্ত্রে সমস্যা, ক্ষুধা কমে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মানসিক সমস্যা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের গত বছরের আগস্টে করা এক গবেষণা পরিচালনা করে। গবেষণায় হয়, করোনার সংক্রমণমুক্ত হওয়ার তিন মাস পরও ৪০ শতাংশ রোগী নানা রকম শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। করোনামুক্ত হওয়ার পর চিকিৎসা নিতে আসা ৫০০ রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, নাকে গন্ধ কম পাওয়া, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, কিডনি, লিভার, নিউরোজনিত সমস্যাসহ ৪০ শতাংশ রোগীর নানা রকম শারীরিক জটিলতা পাওয়া গেছে।
বিএসএমএমইউ’র এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, করোনা পরবর্তী জটিলতা বয়স্কদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ৫০০ রোগীর মধ্যে ৬৮ শতাংশ পুরুষ এবং ৩২ শতাংশ মহিলা। গবেষণায় পোস্ট কোভিড রোগীদের নিয়মিত ফলোআপে থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। করোনা পরবর্তী অনেক রোগীর ফুসফুসের কার্যকারিতা ব্যাহত হওয়ায় শরীরের রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন পৌঁছায় না। রোগী এ সময় অক্সিজেন স্বল্পতায় ভোগেন। এতে কাশি, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিলতা দেখা যায়। একে পালমোনারি ফাইব্রোসিস বলে।
যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধে বলা হয়েছে, করোনা সংক্রমণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্বাসতন্ত্র। এর ফলে কাশি, শ্বাসকষ্ট ও রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা তৈরি হচ্ছে। স্ট্রোক, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, স্বাদ ও ঘ্রাণের সমস্যা, উদ্বেগ ও ঘুমের সমস্যা, নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, স্থূলতা ও কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া, তীব্র হৃদযন্ত্রের সমস্যা, হার্ট ফেইলিওর, ধড়ফড়ানি ও অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, তীব্র কিডনি সমস্যা, শরীরে র্যাশ ওঠা ও চুল পড়া, ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধা, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা হয়।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, করোনা সংক্রমিত হওয়ার পর যেসব জটিলতা দেখা দেয়, তা কাটিয়ে উঠতে অনেকের সময় লাগে। আবার কেউ কেউ দ্রুত সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেন। এটি নির্ভর করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর। বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে, করোনায় আক্রান্ত হয়ে যদি কেউ হাসপাতালে ভর্তি থাকেন তাহলে সুস্থ হওয়ার পরও তার নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলেন, করোনামুক্ত হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পর, এরপর ১ মাস, ৩ মাস ও ৬ মাস পর চিকিৎসকের পরামর্শে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি। এছাড়াও তারা বিশেষ খাবারগ্রহণের প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। তাদের পরামর্শ হচ্ছে, প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় সুষম খাবার রাখা জরুরি। শাক সবজির পাশাপাশি ডিম খাওয়া, দিনে দুই থেকে তিন লিটার পানি খেতে হবে। পাশাপাশি হালকা শরীর চর্চা, হাঁটাহাঁটি করতে হবে। এরপর ১৫ মিনিট তারপর আধা ঘণ্টা সময় করে শরীর চর্চা করতে হবে।