পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন ভারতের কিংবদন্তি গায়ক ও সুরকার বাপ্পি লাহিড়ী। বাপ্পি লাহিড়ী মানেই কি শুধুই ডিস্কো কিং আর শরীর ভর্তি গয়না? জন্মের পর মাত্র ৩ বছর বয়সেই তবলা দিয়ে শুরু হয় বাপ্পিদা’র সংগীতজীবন। তারপর কেটে গেছে ৬৬ বছর। বাপ্পি লাহিড়ীর ৬৯ বছরের ছোট্ট সোনালী জীবনের পরতে পরতেও আছে নানা চড়াই-উতরাইয়ের গল্প। আজ সঙ্গীত জগতের বাপ্পিদা’র স্মরণে আমাদের এই প্রতিবেদন-
ভারতের জলপাইগুড়িতে ১৯৫২ সালের ২৭ নভেম্বর মাসে জন্মগ্রহণ করেন বাপ্পি লাহিড়ী। বাপ্পির বাবা অপরেশ লাহিড়ী আর মা বাঁশুড়ি লাহিড়ী দু’জনেই ছিলেন সঙ্গীত জগতের পরিচিত মুখ। তাই বাসা থেকেই মূলত হাতেখড়ি হয় বাপ্পিদা’র। ৩ বছর বয়সে তবলা বাজানো দিয়ে শুরু করেন সংগীতজীবন। এই শুরু আর থামেনি, চলেছে মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত। একদম ছোট বয়স থেকেই মনে লালিত করা স্বপ্ন নিয়ে মাত্র ১৯ বছর বয়সে পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে। সিনেমা জগতে ১৯৭৩ সালে প্রথম বারের মতো গান লিখেন এই শিল্পী। হিন্দি ভাষায় নির্মিত নানহা শিকারী সিনেমার জন্য সংগীত রচনা করেছিলেন তিনি। এরপর তাহির হুসেনের জখমী (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে কাজ করে তিনি সংগীত রচনাসহ গায়কের চরিত্রে প্রবেশ করেন।
শোনা যায়, ভারতের এই কিংবদন্তি মাত্র ১১ বছর বয়সে গানে প্রথম সুর দিয়েছিলেন তিনি। পরে ১৯৭২ সালে বাংলা ছবি ‘দাদু’-তে সুর দেন তিনি। কথায় বলে বাঙালি জাতি নাকি কাঁকড়ার মতো। তারা সবসময় দল বেঁধে চলাফেরা করে। একে অন্যের পাশে থাকে। সেটাই হয়েছে বাপ্পি লাহিড়ীর সাথে। মুম্বাইয়ে তাকে প্রথম ব্রেক দিয়েছিলেন এক বাঙালি পরিচালকই। তার নাম শমু মুখোপাধ্যায়। শমু মুখোপাধ্যায় ছিলেন ‘নানহা শিকারী’ সিনেমার পরিচালক। তিনি ভারতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী কাজলের বাবা।
১৯৭৪ সালের দিকে ভারতে রাহুল দেব বর্মণ (আর ডি বর্মণ) এর রাজত্ব তুঙ্গে। সিনেমার পরিচালকরা সারাদিন ঘুরেও তার কাছে সময় নিতে পারেন না। সেসময় প্রযোজক তাহির হুসেনের ‘মাদহোস’ সিনেমায় সুর দিয়েছিলেন দেব বর্মণ। কিন্তু তিনি এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে সিনেমার গানের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করার সময় পাচ্ছিলেন না। এমন সময় কপাল খুলে যায় বাপ্পি লাহিড়ীর। আনকোরা বাপ্পিকে দেয়া হয় মাদহোস সিনেমায় আর ডি বর্মণের কাজ! এমন প্রস্তাব কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাননি বাপ্পি। তবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় বাবা অপরেশ লাহিড়ী। তিনি সিনেমার প্রযোজক হুসেনকে জানান, এক শর্তে আর ডি বর্মনের সুর দেয়া সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে বাপ্পি কাজ করবে, তা হলো- বর্মনকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে হবে। যেন ভবিষ্যতে এ নিয়ে কোনো কথা না হয়।
বাপ্পি লাহিড়ীর বানানো সঙ্গিতে কণ্ঠ দেয়া কিশোর কুমারের ‘জালতা হ্যায় জিয়া মেরে’, সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি লতা মঙ্গেশকরের ‘আভি আভি থি দুশমানি’ এখনও সবার মন ছুঁয়ে যায়। এসব কাজ অমর হয়ে থাকবে জন্ম জন্মান্তর। বাপ্পি লাহিড়ীর জীবনের প্রথম হিট সিনেমা জখমী। ওই ছবির প্রযোজক ছিলেন তাহির হুসেন। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন সুনীল দত্ত, আশা পারেখ, রাকেশ রোশন, রীনা রায় সহ অনেকে। পরিচালনায় ছিলেন রাজা ঠাকুর।
‘ডিস্কো কিং’ নামে বিশ্বব্যাপি পরিচিত হলেও বাপ্পি রোমান্টিক গান থেকে শুরু করে ভজন, কাওয়ালি থেকে রাগাশ্রয়ী গান সবখানেই রেখেছিলেন নিজের অবদান। যেন এক সত্যিকারের রকস্টার। ৩৩টি ছবির জন্য ১৮০টি গান রেকর্ড করে ১৯৮৬ সালে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নামও লিখিয়েছিলেন এই গুণী শিল্পী। বাপ্পি লাহিড়ী-ই একমাত্র ভারতীয় মিউজিক ডিরেক্টর যিনি জোনাথন রসের লাইভ পারফরম্যান্সে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে তার আইকনিক গান ‘জিমি জিমি আজা আজা’ গানটি হলিউড সিনেমা ‘ইউ ডোন্ট মেস উইথ দ্য জোহান’স’-এ ব্যবহার করা হয়েছিল।
বৃহদাকার দেহের অধিকারী, বড় বড় চুল, চোখে কালো চশমা, শরীর ঢাকা সোনা, গলায় ভরি ভরি সোনার চেইন আর হার- এটাই ছিল জনসাধারণের চোখে বাপ্পি লাহিড়ী। কিন্তু কী কারণে সবসময় সোনার হার পরে থাকতেন সবার প্রিয় বাপ্পিদা? এর উত্তরও দিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি। এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, প্রথম সোনার চেইন উপহার দিয়েছিলেন মা, এরপর স্ত্রী গণেশের লকেট দেয়া এক চেইন উপহার দেন। তিনি মনে করেন, সোনা তাঁর জন্য বেশ ভাগ্যবান। আর সেজন্য সবসময় সোনা পরে থাকার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০১৪ সালে নির্বাচনের জন্য সম্পত্তির ডিক্লারেশনে তিনি জানিয়েছিলেন তার কাছে ৭৫৪ গ্রাম সোনা রয়েছে।
বাপ্পি লাহিড়ীর সম্পত্তির পরিমাণ ৩ মিলিয়ন ডলার। মাসে প্রায় ২০ লাখ টাকার মতো আয় করতেন এই শিল্পী। বাৎসরিক ২ কোটির বেশি ছিল তার আয়। বিভিন্ন মিউজিক কম্পোজিশনের পাশাপাশি স্টেজ শো থেকে প্রচুর উপার্জন করতেন বাপ্পি। সিনেমার একটা গানের জন্য ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা পারিশ্রমিক নিতেন এই জাদুকর।
বাপ্পি লাহিড়ীর অনবদ্য সৃষ্টি
মিঠুন চক্রবর্তী’র ডিস্কো নাচের চলচ্চিত্রগুলোতে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন বাপ্পি দা। ৮০’র দশকে মিঠুন এবং বাপ্পি একসাথে বেশ কিছু ডিস্কো চলচ্চিত্রে কাজ করেন। তিনি দক্ষিণ ভারত থেকে পরিচালিত অনেক হিন্দী চলচ্চিত্রের কাজ করেছেন। সমগ্র ভারতবর্ষে তিনি তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৯০’র দশকে ভারতীয় চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন এই কিংবদন্তি। তবে বাপ্পি লাহিড়ী ভারতীয় চলচ্চিত্রে ও ভারতীয় ধাঁচের ডিস্কো সঙ্গীত বানাতেন। তার সৃষ্ট গানগুলো কিশোর কুমার এবং আশা ভোঁসলের কণ্ঠে চলচ্চিত্রের পর্দায় অমর হয়েছে।
বাপ্পিদা’র গানগুলো বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম, এক বার কহো (১৯৮০); সুরক্ষা; ওয়ারদাত; আরমান; চলতে চলতে; কমাণ্ডো; ইলজাম; পিয়ারা দুশমন; ডিস্কো ড্যান্সার; ড্যান্স ড্যান্স; ফিল্ম হি ফিল্ম; সাহেব; টারজান; কসম পয়দা করনে ওয়ালে কি; ওয়ান্টেড: ডেড অর এলাইভ; গুরু; জ্যোতি; নমক হালাল; শরাবী (১৯৮৫: ফিল্মফেয়ার সেরা সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার); এইতবার; জিন্দাগী এক জুয়া; হিম্মতওয়ালা; জাস্টিস চৌধুরী; নিপ্পু রাব্বা; রোদী ইন্সপেক্টর; সিমহাসনম; গ্যাং লিডার; রৌদী অল্লাদু; ব্রহ্মা; হাম তুমহারে হ্যায় সনম এবং জখমী।