‘ভুয়া বিজ্ঞপ্তি’ নিয়ে তোলপাড় জাতীয় পার্টি

মঙ্গলবার আচমকাই জাতীয় পার্টিতে (জাপা) শোরগোল। জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে, দলটির পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। এতে দলটির ৪ জন কো চেয়ারম্যান ও ২ জন প্রেসিডিয়াম সদস্যেরও সায় আছে, এমন বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।

রওশন এরশাদ দলটির নতুন চেয়ারম্যান এমন খবরে বনানীতে জিএম কাদেরের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেন জাপার অনেক নেতাকর্মীও।

এমন এক সময় এ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলো, যখন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের তিন দিনের সফরে ভারতে অবস্থান করছেন। আর গত ২০ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ।

যদিও জাপার এ ধরনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল নতুন নয়। দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ দলটির চেয়ারম্যান থাকার সময়ও একাধিকবার দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন তার স্ত্রী ও দলটির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। এরশাদের মৃত্যুর পর দেবর ও দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান রওশন।

শীর্ষ নেতাদের দ্বন্দ্বের জেরে দলটিতে দুটি ধারা এখন স্পষ্ট। জিএম কাদেরপন্থিদের দাবি, বিভিন্ন কারণে দল থেকে বহিষ্কৃতরা রওশনপন্থিদের নেতৃত্বে আছেন। তারা গঠনতন্ত্র বহির্ভূত কাজ করায় দলটির ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।

২২ আগস্ট বেলা ১১টা ৪১ মিনিটে প্রেস নোট (জাপা) নামক হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে লাঙল মাল্টিমিডিয়ার পক্ষে কাজী লুৎফুল কবীর জানান, দলের পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। এতে জাপার ৬ জন শীর্ষ নেতার সম্মতি রয়েছে মর্মে তাদের স্বাক্ষর সম্বলিত সভার কার্যবিবরণীও দেওয়া হয়।

যদিও দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তথ্যটি সঠিক নয়। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে এভাবে চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ নেই।

গত বছর ৭ ডিসেম্বর সভার এক কার্যবিবরণীতে বলা হয়, মামলা-মোকদ্দমায় জাতীয় পার্টির চলমান অচল অবস্থা নিরসনে ৪ জন কো-চেয়ারম্যান ও ২ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদকে সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। এতে তাদের স্বাক্ষর রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পার্টির চার কো-চেয়ারম্যান ও ২ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রধান পৃষ্ঠপোষককে ক্রান্তিকাল মোকাবিলায় অস্থায়ী ভিত্তিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব অর্পণ করেন। কো-চেয়ারম্যানরা হলেন, এ.বি.এম রুহুল আমিন হাওলাদার ,অ্যাডভোকেট. কাজী ফিরোজ রশীদ, এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, অ্যাড. সালমা ইসলাম। আর প্রেসিডিয়াম সদস্য আলহাজ শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও ডা. নাছরিন জাহান রত্নী। যা মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) রওশন এরশাদ গ্রহণ করেছেন বলে দেখা যায়।

তবে এটি অস্বীকার করেছেন রওশনপন্থিরা। রওশন এরশাদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। এতে ৩ জায়গায় পার্টির স্থলে লেখা হয়েছে ‘পাটি’। আর চেয়ারম্যানের স্থলে লেখা হয়েছে ‘চেয়াম্যান’। এছাড়া রওশনকে চেয়ারম্যান করতে সম্মতিক্রমে ৬ নেতার স্বাক্ষর সম্বলিত যে কার্যবিবরণী আছে তাতে তারিখ দেওয়া আছে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর। যা রওশন এরশাদ ২২ আগস্ট গ্রহণ করছেন মর্মে স্বাক্ষর করেন।

এ বিষয়ে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ জাগো নিউজকে বলেন, যারা প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, তারা বিস্তারিত বলতে পারবে। রওশনপন্থি নেতা ইকবাল হোসেন রাজু বলেন, বিষয়টি আমি এখনো ক্লিয়ার না। আপনাকে পরে জানাতে পারবো।

এদিকে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আবার জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ বলেন, রওশন এরশাদ এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কিছুই জানেন না। নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণার প্রশ্নই আসে না। আমাদেরই কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে এটি ছড়িয়েছেন। তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, যে কেউ ইচ্ছা করলেই নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করতে পারেন না। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে হয়।

অন্যদিকে, রওশনকে জাপার নতুন চেয়ারম্যান ঘোষণার ‘ভুয়া’ বিজ্ঞপ্তির প্রতিক্রিয়ায় দলটির মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নু বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এটি সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এ খবর ভুয়া। আমাদের দলের গঠনতন্ত্রে এভাবে কারো চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ নেই। জাতীয় পার্টি গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছে। আমার মনে হয় কিছু ব্যক্তি যারা দল থেকে বহিষ্কৃত তারা ম্যাডামের (রওশন) নামটা ব্যবহার করে ফেইক নিউজ দিয়েছে। মজিবুল হক চুন্নু আরও বলেন, যাদের স্বাক্ষর করার কথা বলা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্তের সহযোগিতা করেন নাই। কোনো স্বাক্ষর দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। দলের বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি এটি শুনে ‘হাস্যকর’ বলেছেন।

জাপার কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এক ভিডিওবার্তায় বলেন, খবরটি সম্পূর্ণ ভুয়া, উদ্ভট ও বানোয়াট। পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের আছেন, থাকবেন। রওশন এরশাদ আমাদের মায়ের মতো, তিনি আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আমি সবসময়ই বলি রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরসহ জাপার সবাই এক সূতোয় গাঁথা। এ ধরনের ভুয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।

তবে রওশনকে চেয়ায়ম্যানকে করার সিদ্ধান্তে সম্মতির কার্যবিবরণী সভাপত্রে বাবলারও স্বাক্ষর ছিল।

কার্যবিবরণী সভাপত্রে স্বাক্ষর থাকা জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু ভিডিও বার্তায় বলেন, খবরটি সম্পূর্ণ ফেক। রওশন ম্যাডাম দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডে চিকিৎসার পর গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে ফিরলে আমরা অনেকেই তাকে দেখতে যাই। তখন সেখানে একটি রেজিস্ট্রার বুক ছিল, সেখানে সবাইকে স্বাক্ষর করে তারপর দেখা করতে হতো। আমাদের তখনকার সেই স্বাক্ষরকে স্ক্যানিং করে এই জালিয়াতি করা হয়েছে।

আরেক স্বাক্ষরকারী কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আমি কখনো রওশন এরশাদকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করি নাই। এক বছর, দুই বছর আগের কোনো স্বাক্ষরকে কেন্দ্র করে এ ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানোর সুযোগ নেই।

২০১৯ সালে এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে আসেন তার ছোট ভাই জি এম কাদের। যদিও শুরু থেকেই এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছিলেন রওশন। সমঝোতার মাধ্যমে জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান ও রওশন এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা করা হয়।

২০২২ সালে দলের গৃহবিবাদ ফের প্রকাশ্যে আসে। ওই বছরের আগস্টে থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রওশন এরশাদ কেন্দ্রীয় সম্মেলন ডাকেন। এর জেরে রওশনের ঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন চেয়ারম্যান জি এম কাদের।

জি এম কাদেরের চেয়ারম্যান পদে থাকাকে চ্যালেঞ্জ করে একাধিক মামলাও করা হয়। এতে শুরুতে জি এম কাদেরের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন আদালত। পরে অবশ্য উচ্চ আদালতের রায়ে চেয়ারম্যান পদ ফিরে পান জি এম কাদের।

জিএম কাদের ও রওশন এরশাদ সাক্ষাৎ করেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে দেবর-ভাবির মিটমাট হয়ে গেছে বলে গুঞ্জন ছড়ায় সে সময়। ১৪ ডিসেম্বর জাপা চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের দায়িত্ব পালন-সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে করা আবেদন নিষ্পত্তি করে দেন আপিল বিভাগ। এরপর ওই রাতেই রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে রওশনপন্থি কিছু নেতা। ঘোষণার দেড় ঘণ্টা পর তা আবার স্থগিতও করা হয়।

ফেসবুক ও হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে জাতীয় পার্টি ও বিরোধীদলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মো. মামুনুর রশীদ এবং বিরোধীদলীয় নেতার প্রেস উইংয়ের পক্ষে কাজী লুৎফুল কবীরের বরাত দিয়ে বলা হয়, দলীয় কার্যক্রম পরিচালনায় আইনি জটিলতা নিরসন না হওয়া পর্যন্ত রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ কো-চেয়ারম্যানদের মতামত ও সিদ্ধান্ত মোতাবেক এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে ছয়জন নেতার নামও উল্লেখ করা হয়।

অন্য এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সভায় উপস্থিত নেতাদের স্বাক্ষরপত্রসহ বিস্তারিত আসছে। কিন্তু ওইদিন রাত সাড়ে ১০টায় ভিন্ন বার্তা দেওয়া হয়, রওশন এরশাদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়ার আদেশ স্থগিত করা হয়েছে।আবার রাত ১০টা ৩৬ মিনিটে ‘ডিপিএস টু এইচএম এরশাদ (অনলাইন)’ নামক চ্যাটগ্রুপে জাপার দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম জানান, রওশন এরশাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কোনো এখতিয়ার নেই। দলের গঠনতন্ত্রের ধারা উল্লেখ করে তিনি বলেন, অদ্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদকে নিয়োগের যে বিভ্রান্তিকর খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা পার্টির গঠনতন্ত্রের ধারা ২০, উপধারা ২ (খ) এর পরিপন্থি।

তাতে আরও বলা হয়, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদের ওপর আদালত কর্তৃক কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি হয় নাই। অস্থায়ীভাবে চেয়ারম্যানের গঠনতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা আছে। এ কারণে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম মোহাম্মদ কাদের স্বপদে বহাল আছেন। বিধায় অন্য কারো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার কোনো এখতিয়ার বা সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে জাতীয় পার্টির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বানও জানানো হয়।

সে সময় জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুর জাগো নিউজকে বলেন, ওটা কি আছে (রওশন এরশাদের ভারপ্রাপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত)? এখন তো নাই। হবে তো অনেক কিছুই বলা হয়। এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয় নাই। কো-চেয়ারম্যানদের কাছে জানতে চান তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না। তবে আমি এতটুকু জানি, কো-চেয়ারম্যান বা অন্য কেউ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। ইভেন প্রেসিডিয়ামও না। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, অসুস্থতা বা অন্য কারণে এই দায়িত্ব শুধু চেয়ারম্যানই সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান অথবা প্রেসিডিয়ামের মধ্যে কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিতে পারেন। এর বাইরে কেউ দেওয়ার এখতিয়ার নাই। আমার দলে কেউ এটা করছে বলে আমার জানা নাই।

Please follow and like us:

     এই বিভাগের আরো খবর

আমাদের পেজ লাইক করুন

error: Content is protected !!